ঢাকা, ডিসেম্বর ৮ (থমসন রয়টার্স ফাউন্ডেশন) - সৌদি আরব গিয়ে একজন দর্জি হওয়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন পারভেজ মোরশেদ। কিন্তু নিয়োগদাতাদের ফাঁদে পড়ে তার কাজ জুটেছে একজন নির্মাণশ্রমিক হিসেবে এবং তিনি রোজগার করতে পেরেছেন প্রতিশ্রুত বেতনের অর্ধেক।
পরিবার চালাতে সহায়তা করতে এবং চাকরি পাওয়ার জন্য ঋণ করা অর্থ পরিশোধ করতে অক্ষম মোরশেদ মহামারীর মাঝপথে দেশে ফেরেন এবং একটি গার্মেন্ট কারখানায় চাকরি নেন যেখানে পাচারের শিকার হওয়াদের চাকরি দেওয়ার একটি উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে।
থমসন রয়টার্সকে ফোনে মোরশেদ বলেন, “ভেবেছিলাম সৌদির চাকরিটি আমার পরিবারকে অভাব থেকে রক্ষা করবে। কিন্তু বাস্তবে তা আমাদের আগের চেয়ে বেশি বিপদে ফেলেছে।”
চার মাস ধরে নতুন চাকরি করা ৩০ বছর বয়সী এই দর্জি আরো বলেন, “করোনাভাইরাসের কারণে চাকরি পাওয়া খুবই কঠিন। সে হিসেবে এখানে কাজ করতে পেরে আমি নিজেকে সৌভাগ্যবান ভাবছি। এই চাকরিটির কল্যাণে আমার পরিবার আরো বড় বিপদ থেকে বেঁচে গেছে।”
মোরশেদ আসলেই খুব অল্প সংখ্যক সৌভাগ্যবানদের একজন।
ভূয়া চাকরির ফাঁদে পড়ে পাচারের শিকার হওয়া এবং শেষ পর্যন্ত ঋণের বোঝায় চাপা পড়া ও অত্যন্ত শোচনীয় পরিবেশে চাকরি করতে বাধ্য হওয়া বাংলাদেশিদের সাহায্য করা কয়েকটি দাতাসংস্থা মনে করে করোনাভাইরাসের কারণে দেশে আয়-রোজগারের পথ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় অনেকে নতুন করে পাচারকারীদের ফাঁদে পড়তে পারেন।
মহামারীর শুরুর দিকে বেশ কয়েকটি বড় আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ড ক্রয়াদেশ বাতিল করে দেওয়ায় অন্তত ৭০,০০০ বাংলাদেশি গার্মেন্টকর্মী চাকরি হারিয়েছেন।
নিয়মিত বেতন পরিশোধ-করা এবং ঋণমুক্ত প্রতিষ্ঠানে চাকরি পাওয়া- যেমন মোরশেদ পেয়েছেন- খুবই কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
পাচারের শিকার হওয়াদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনা এবং তাদের নিরাপদ রাখা প্রতিষ্ঠানগুলো বলছে বেশির ভাগ লোক কোভিড-১৯ এর কারণে চাকরি হারিয়েছেন এবং তারা এই ভয় পাচ্ছেন যে উদ্ভুত পরিস্থিতি তাদেরকে আবার পাচারের শিকার হওয়ার ঝুঁকিতে ফেলতে পারে।
গবেষণা-ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান আইএনসিআইডিআইএন বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক মাসুদ আলি বলেন, “পাচার থেকে বেঁচে যাওয়ার এমন চাপে থাকেন যে তারা আবার পাচারের শিকার হওয়ার সহজ লক্ষ্যে পরিণত হন।”
তিনি আরো বলেন, “একজন পাচারের শিকার মানুষ যখন দেশে ফিরে এসে পরিবারের সাথে থাকেন, কিন্তু কোনো আয়-রোজগার করতে পারেন না; তখন তিনি আসলে পরিবারের বোঝায় পরিণত হন। একই সাথে তাকে পাচারের শিকার হওয়ার কলঙ্কও বয়ে বেড়াতে এবং এই বাস্তবতা তাদেরকে নতুন করে বিপদে পড়ার ঝুঁকিতে ফেলে দেয়।”
পাচারের শিকার হওয়া ব্যক্তি থেকে তৃতীয় লিঙ্গের ব্যক্তি
দাতাসংস্থা ইউনরক ইন্টারন্যাশনালের মতে, তারা পাচার থেকে বেঁচে যাওয়া যে ৭৭ জন ব্যক্তিকে সাহায্য করে, তাদের মধ্য থেকে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের শহর রংপুরের ৭২ জনের বেশির ভাগের রোজগার গত এপ্রিল থেকে আগস্ট পর্যন্ত সময়ে কমে গেছে এবং ১৪ জন চাকরি হারিয়েছেন।
দাতাসংস্থা জাস্টিস অ্যান্ড কেয়ার বলছে, পাচার থেকে বেঁচে যাওয়া প্রায় ৪০০ ব্যক্তির পরিবারকে মহামারীর সময়ে টিকে থাকার জন্য এবং আবার পাচার হওয়া থেকে রক্ষা করার জন্য খাবার সাহায্য করতে হয়েছে।
একই সাথে মহামারীর সময়ে টিকে থাকার জন্য যারা ঋণ করেছেন, তাদেরকে এখন বাড়তি চাপ সহ্য করতে হচ্ছে এবং তাদের পাচার হওয়ার ঝুঁকিও বেড়ে যাচ্ছে।
এসব কারণেই মূলত মোরশেদের কারখানার চাকরিটি তাকে আলাদা নিরাপত্তা দিচ্ছে।
তাকে চাকরি দেওয়া প্রতিষ্ঠান ডেনিম এক্সপার্টের মালিক মোস্তাফিজ উদ্দিন এ বিষয়ে বলেন, “পাচারের শিকার হওয়া কোনো ব্যক্তি চাকরি দেওয়া মানে হলো তাকে আত্মঘাতী হওয়া থেকে রক্ষা করা।”
তিনি আরো বলেন, “পাচারের শিকার হওয়া ব্যক্তিরা সব কিছু হারিয়ে একেবারে মুষড়ে পড়েন। সবাই, এমন কি তাদের পরিবারও তাদেরকে ব্যর্থ হিসেবে গণ্য করে … সুতরাং তাদেরকে চাকরি দেওয়া মানে হলো তাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা যা টাকার চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এটি মানসিক প্রশান্তিদায়ক ব্যাপার।”
এই প্রতিষ্ঠানটি এইচএন্ডএম এবং জারার মতো প্রতিষ্ঠানের জন্য পোশাক তৈরি করে এবং এখানে প্রায় ১,৯০০ লোক ব্যক্তি কাজ করেন। প্রতিষ্ঠানটি ২০১৮ সাল থেকে শোষণের শিকার হওয়া ব্যক্তিদের কাজ দেওয়া শুরু করে।
এই উদ্যোগটি ছোট হলেও, উদ্দিন মূলত একেবারে নতুন কিছু করছেন। তিনি এরই মধ্যে তিনজন পাচারের শিকার হওয়া থেকে বেঁচে যাওয়া ব্যক্তিকে চাকরি দিয়েছেন এবং আরো চারজনের সঙ্গে আলোচনা করছেন।
তিনি বলেন, “এটি তুলনামূলকভাবে খুবই ছোট উদ্যোগ এবং আরো লোককে নিয়োগ দিতে চাই। কিন্তু তাদেরকে চাকরিতে রাজি করানো সহজ নয়। তারা অনেক যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে গিয়েছেন, ফলে কাজ দেওয়ার কথা বললে তারা আমাদের সহজেই বিশ্বাস করতে পারেন না। তাদের অনেকে আমাদেরকে দালাল মনে করেন।”
এই ডেনিম কারখানাটি তৃতীয় লিঙ্গের ব্যক্তিদেরও চাকরি দেয়; এখানে এখন পাঁচজন তৃতীয় লিঙ্গের ব্যক্তি কাজ করছেন। প্রতিষ্ঠানটি প্রান্তিক জনগোষ্ঠির যৌনকর্মীদের কাজ দেওয়ার উদ্যোগও গ্রহণ করছে।
আছে নতুন ঝুঁকি
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, পাচার থেকে বেঁচে যাওয়া ব্যক্তিরা চাকরি হারানো ও রোজগার বন্ধ হওয়ার পরিস্থিতির সাথে মানিয়ে নিতে গিয়ে কঠিন অবস্থার মুখে পড়েন এবং আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলেন। তারা আরো বলেন, মহামারীর কারণে চাকরি হারিয়ে ফেলা তাদেরকে আবার পাচারকারিদের দৃষ্টিতে নিয়ে আসে।
দক্ষিণ এশিয়ান দেশগুলোতে পাচার-বিরোধী কার্যক্রম চালানো জাস্টিস অ্যান্ড কেয়ারের বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর তারিকুল ইসলাম বলেন, “তারা প্রায়ই হাল ছেড়ে দেন। আমি অনেককে কাজের চাপের কারণে চাকরি ছেড়ে দিতে দেখেছি।”
তিনি আরো বলেন, “এরপর তারা এমন লোকদের উপর ভরসা করে যারা সহজেই টাকা কামানোর পথ দেখায়, এবং এখানেই আবার পাচার হওয়ার নতুন ঝুঁকি থাকে..। চাকরি হারিয়ে ফেলা অনেক ব্যক্তিকে পুনর্বাসন প্রক্রিয়া নতুন করে শুরু করার ঝুঁকির মধ্যেও ফেলে দেয়।”
এই পরিস্থিতির সমাধান করার জন্য আইনজ্ঞদের পরামর্শ হলো, পাচারের শিকার থেকে বেঁচে যাওয়া কর্মীদের একটি তালিকা প্রণয়ন করা এবং বৈধ উপায়ে বিদেশে চাকরি দেওয়ার ক্ষেত্রে তাদেরকে প্রাধান্য দেওয়া।
মানবপাচারের জন্য পরিচিত শহর যশোরে কর্মরত একজন সরকারি কর্মকর্তা এ কথা স্বীকার করেছেন যে, পাচারের শিকার হওয়াদের নিরাপদ রাখার জন্য এখনো অনেক কাজ করতে হবে।
সহকারি পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করা অসিত কুমার বলেন, “পাচারের শিকার হওয়া থেকে বেঁচে যাওয়ারা যাতে চাকরি পান তা নিশ্চিত করতে আমরা তাদেরকে আরো বেশি প্রশিক্ষণ দেওয়ার চেষ্টা করছি।”
পাচারের শিকার হওয়ার পর গত আগস্টে চাকরি হারানো মিতা নামের একজন কোথাও সাহায্য পাচ্ছেন না। তিনি জানেন না কিভাবে তার পরিবারকে সহায়তা করবেন।
২২ বছর বয়সী মিতা মাত্র ১৩ বয়সে পাচারের শিকার হন এবং মুম্বাইয়ের এক পতিতালয়ে তাকে বিক্রি করে দেওয়া হয়। পরে উদ্ধার হওয়ার পর তিনি সরকারি আশ্রয়ে ছিলেন এবং ২০১৭ সালে তিনি দেশে ফিরে আসেন।
সব কিছু নতুন করে শুরু করার চেষ্টায় পরের বছর তিনি একটি গার্মেন্ট কারখানায় চাকরি নেন, কিন্তু মহামারীতে সেই চাকরিটিও হারান তিনি।
এখন তিনি আবার পুরোনো অন্ধকারে পিছলে পড়ার আতঙ্কে রয়েছেন।
মিতা বলেন, “আমি জীবনে বহু সমস্যার মধ্য দিয়ে গেছি। কিন্তু এখন আমি অনেক বেশি চিন্তিত কারণ আমার কোনো চাকরি নেই এবং আমি জানি না আমার মাকে কিভাবে সহায়তা করবো।”
Our Standards: The Thomson Reuters Trust Principles.
